সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৩ পূর্বাহ্ন
রাজাপুর প্রতিনিধি॥ স্বামীর সংসারে এসে কখনোই সুখের মুখ দেখেননি সেতারা বেগম। যুগ যুগ ধরে জীবন বাঁচার সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন তিনি। রোদ, বৃষ্টি ও তীব্র শীতও দমাতে পারেনি তার পথচলা। দু’মুঠো খাবারের জন্য ১৯৯০ সালের দিকে হাতে নিয়েছিলেন ভিক্ষার ঝুলি। কখনো শাক-সবজির দোকান আবার কখনো চায়ের দোকান। কিছুতেই যেন দুঃখ তার পিছু ছাড়ছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন তার সংসারের হাহাকার তীব্র হচ্ছে। নেই খাবার ও মাথা গোজার ঠাঁই। অসুস্থ দৃষ্টিহীন স্বামীর জন্য নেই চিকিৎসার খরচ।
অপর দিকে ঋণের বোঝা তার মাথায়। প্রতি সপ্তাহে গুনতে হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি। ঝালকাঠির রাজাপুরের শুক্তগড় ইউনিয়নের কেওতা গ্রামের দুই নম্বর ওয়ার্ডের দৃষ্টিহীন আ: মালেকের (৮০) স্ত্রী সেতারা বেগম (৬২)। তাদের জীবনের কষ্টের কথাগুলো এভাবে বললেন।
সেতারা বেগম বলেন, স্বামী মালেক ৪০ বছর আগে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে অসুস্থ হন। শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারেন না। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা না করাতে পারায় তিনি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত চার থেকে পাঁচ মাস আগে মালেকের চোখে সানি পড়ে দৃষ্টি হাড়িয়ে ফেলেন তিনি। মালেকের বসত ভিটায় ৩৩ শতাংশ জমি থাকলেও অর্থের অভাবে সেখানে ঘর তৈরি করতে পারেননি। বর্তমানে তারা থাকেন উপজেলার বাগরী এলাকার ব্রাক অফিসের দক্ষিণ পাশের রুহুল আমিনের পরিত্যাক্ত জমিতে এক কক্ষ বিশিষ্ট পলিথিনের চালার ঝুপড়ি ঘরে।
সেতারা বেগম জানান, তার সংসারে অভাব দেখা দিলে প্রথমে তিনি দুই থেকে তিন বছর ভিক্ষা করেন। অষ্টম শ্রেণী পাস সেতারা ভিক্ষাবৃত্তি ভালো কাজ নয় তা বুঝতে পেরে ভিক্ষা করা ছেড়ে দিয়ে দুই ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে খুলনায় চলে যান। সেখানে তিনি অসুস্থ স্বামীকে সাথে নিয়ে প্রায় আট বছর শাক-শবজির ব্যবসা করেন। ওই ব্যবসায় ভালোভাবে সংসার না চলায় সেখান থেকে বরিশালে এসে রুপাতলিতে একটি চায়ের দোকান দেন। বরিশালে থাকতে মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতেন তারা। বসত ভিটায় বাঁশ দিয়ে একটি ঘর ছিল তাদের। সংসার চালাতে কষ্ট হলে বাড়িতে এসে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে লোন নেন সেতারা। লেনদেনের মাধ্যমে লোনের পাল্লা ভারী হতে থাকে। বৃদ্ধি পায় কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ।
তিনি আরো বলেন, ২০০৭ সালের সিডরে তছনছ হয়ে যায় তাদের ঘরটি। এর পর ভাড়া থাকেন রাজাপুরের বিভিন্ন জায়গায়। ইতোমধ্যে পর পর বিয়ে করেন তাদের দুই ছেলে হুমায়ুন কবির ও সুমন। তারা বর্তমানে সংসার নিয়ে আলাদা থাকছেন। তারা দুই ভাই রিকশা চালিয়েই সংসার চালাতেন। বাবা-মাকে খাওয়ানোর মতো সামর্থ নেই তাদের। ছোট ছেলে সুমন অসুস্থ দৃষ্টিহীন বাবা মালেককে তার কাছে নিতে চাইলেও মালেক তার স্ত্রী সেতারাকে ছেড়ে শেষ বয়সে কোথাও যেতে চাচ্ছেন না। মালেক চোখে না দেখলেও সেতারা বাজারে শাক-শবজি বিক্রির সময় সেতারার হাত ধরে এসে দোকানের পাশেই চুপ করে বসে থাকেন। অদৃশ্য মায়ার বন্ধনে একে অন্যের পরিপূরক তারা। দু’জন দু’জনার কত যে আপন কেউ জানে না। ওই ঝুপড়ি ঘরে থেকে সেতারা প্রতিদিন বিকেলে গ্রামে গ্রামে হেঁটে হেঁটে অল্পদামে হরেক রকমের শাক-শবজি কিনে এনে সপ্তাহের সাত দিনই রাজাপুরের হাট ও বাজারে বিক্রি করেন।
কীভাবে ওই টাকায় সংসার, অসুস্থ স্বামীর ওষুধের খরচ ও ঋণের টাকা পরিশোধ করেন সেই ব্যাপারেও বললেন এ প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, আয় করা টাকায় নিজেদের খাবার, স্বামীর প্রতি মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকার ওষুধ ও গ্রামীণ ব্যাংকের সপ্তাহে ১২ শ’ টাকার কিস্তি পরিশোধ করেন। আরো দুই বছর কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। তবে সরকারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা পেলে বা বিনা সুদে টাকা পেলে একটি দোকান দিয়ে একটু ভালোভাবে জীবন-যাপন করতে পারতেন।
অসুস্থ দৃষ্টিহীন আ: মালেক বলেন, ‘অনেক দৌড়-ঝাপ করে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করিয়েছি। তীব্র শীতে খুব কষ্টে ঝুপড়ি ঘরে থেকেছি, কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি। পায়নি একটুকরা শীতের বস্ত্র। শুনছি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গৃহহীনদের ঘর দেয়া হচ্ছে। আমার সেতারাও স্থানীয় মেম্বর মনিরের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি অজ্ঞাত কারণে ঘর পাওয়ার জন্য আমাদের কোনো কাগজপত্র নেননি। পরে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘর পাওয়ার জন্য শুক্তগড় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবুল হকের কাছে কাগজপত্র দিয়েছি। আমাদের একটি ঘরের খুবই প্রয়োজন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার চোখে সানি পড়েছে। আমি দু’চোখেই ঝাপসা দেখছি। ক্লিনিকের ডাক্তার বলেছেন, অপারেশন করাতে পারলে চোখে দেখতে পাবো। তবে অপারেশন করাতে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা লাগবে। অর্থের অভাবে অপারেশন করাতে পারছি না।’
বিত্তবান কোনো ব্যক্তি আর্থিক সাহায্য করলে আ: মালেক ফিরে পেতে পারে তার চোখের দৃষ্টি। এ ব্যাপারে শুক্তগড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুল হক বলেন, সেতারা-মালেক দম্পতি খুবই অসহায় অবস্থায় আছে। তাদের একটি ঘরের খুবই প্রয়োজন। ঘর পাওয়ার জন্য পিআইও অফিসে তাদেরকে একটি দরখাস্ত করতে বলা হবে।
এ বিষয়ে স্থানীয় মনির মেম্বার বলেন, ‘আমার কাছে মালেক বা সেতারা কখনোই আসেননি। কে কোথায় থাকে কীভাবে জানবো? আমার কাছে এলে আমি তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করবো।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মোক্তার হোসেন বলেন, বর্তমানে যাদের জমি ও ঘর নেই, তাদেরকে জমিসহ ঘর দেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে যাদের জমি আছে ঘর নেই, তাদেরকে ঘর দেয়া হবে। মালেকের তো জমি আছে। তাই দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হলে যাচাই-বাছাই করে ঘর পাওয়ার উপযুক্ত হলে তাকে ঘর দেয়া হবে। মালেক-সেতারা দম্পতিকে কেউ সাহায্য করতে চাইলে তার জন্য সেতারার বিকাশ নম্বর দেয়া হলো-০১৭৮০-২৩৩৯৭১।
Leave a Reply